যেকোন ধরণের ধর্মীয় প্রশ্নের উত্তর জানতে বামে মেজেজ্ঞার আইকনে ক্লিক করে আমাদের প্রশ্নটি লাইভ চ্যাটের মাধ্যমে জানান, SanatanLive.blogspot.com

পরমাণুবিদ মহর্ষি কণাদ

ভারতীয় দার্শনিক কণাদ খ্রীস্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে পরমাণুর ধারণা দেন। তিনি বলেন সকল পদার্থই ক্ষুদ্র এবং অবিভাজ্য কণিকা দ্বারা তৈরী। পরমাণু তত্ত্ব গ্রিক দার্শনিকেরা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ ব্যবহার করে নয়, বরং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পদার্থের তত্ত্ব নির্মাণের চেষ্টা করেন।

নামকরণ: বৈশেষিক দর্শনকার কণাদ ঋষি খ্ৰীঃ পূঃ ৬০০শ শতাব্দীতে বৰ্ত্তমান ছিলেন। মহর্ষি কণাদ ‘কণভূক’, ‘কণভক্ষ’, ‘যোগী’, ‘উলূক’, ‘কাশ্যপ’ প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিলেন।  তাঁহার প্রণীত দর্শন ‘ঔলুক্যদর্শন’ নামেও খ্যাত। তিনি প্রভাসক্ষেত্রে বাস করিতেন এবং তাঁহার গুরুর নাম সোমশৰ্ম্মা ছিল।  প্রবাদ আছে যে, তিনি দিবাভাগে গহন অরন্যে গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন এবংরাত্রিকালে সবাই যখন নিদ্রিত থাকতো তখন তিনি আহারান্বেষণে বের হতেন। এরকম বৃত্তি উলূক বা পেচকের বৃত্তি তুল্য বলেতাঁর উলূক নামকরণ করা হয়েছে। মহাভারতের শান্তিপর্ব-১১-এ এরকম কাহিনীর ছায়া রয়েছে- ‘উলূকঃ পরমো বিপ্রো মার্কণ্ডেয় মহামুনিঃ’।অন্য এক প্রবাদে বলা হয়েছে কণাদ কঠোর যোগাভ্যাসের ফলে শিবের অনুগ্রহ লাভ করেন। শিব কণাদের তপশ্চর্যায় সন্তুষ্ট হয়ে উলূকের রূপ ধরে তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হন এবং ষটপদার্থের উপদেশ দান করেন। বায়ুপুরাণেও উল্লেখ আছে যে, কণাদ পরম শৈব ছিলেন। ‘কণাদ’ নাম প্রসঙ্গে ন্যায়-কন্দলীতে উল্লেখ আছে, ক্ষেত্রে পড়ে থাকা শস্যকণা ভক্ষণ করে অর্থাৎ একপ্রকার ভিক্ষাবৃত্তির দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন ( তণ্ডুলকণা ভক্ষণ করিতেন)  বলে তাঁকে কণাদ বলা হতো। এবং এ কারণেই তাঁকে কণভূক বা কণভক্ষ বলা হতো। আবার কণাদ কাশ্যপ গোত্রীয় ছিলেন বলে তাঁর দর্শনকে কাশ্যপীয় দর্শনও বলা হয়। মোটকথা বৈশেষিক সূত্রকারের বিবিধ নাম অবলম্বনেই এই সম্প্রদায় বিভিন্ন নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে সাধারণভাবে এই দর্শন ‘বৈশেষিক দর্শন’ নামেই পরিচিত।



অবদান : ইনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী। জীবনের কঠোরতাকেই ঋষিদের আধ্যাত্মিক উন্নতির মূলসূত্র হিসাবে বিবেচনা করেছেন। ইনি 'বিশেষ' নামকএকটি সুক্ষ্ম পদার্থ স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাঁর মতে- পদার্থ মূলত ১০ প্রকার। এর মধ্যে ছয়টি ভাব পদার্থ বাকি চারটি অভাব পদার্থ। ছয়টি পদার্থ হল- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ ও সমব্যয়। অপর চারটি অভাব পদার্থ হল- প্রাগভাব, ধ্বংসাভাব, অন্যোন্যভাব ও অত্যন্ত্যভাব।


ইনি প্রথম পরমাণু সম্পর্কে বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। তাঁর মতে- একমাত্র পরমাণুই সত্স্বরূপ নিত্যপদার্থ এবং সমস্ত জড় পদার্থই পরমাণুর সংযোগে উৎপন্ন হয়েছে। বিশেষ বিশেষ প্রকার পরমাণুতে বিশেষ নামে পদার্থ আছে। তারই শক্তিতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরমাণু ভিন্ন হিসাবে চিহ্নিত হয়। ইনি প্রথম তেজ ও আলোকে একই বস্তুর বিভিন্ন অবস্থা হিসাবে চিহ্নিত করেন। ইহা তিনিই প্রথম আবিস্কার করেন। বর্ত্তমান সময়ে ইউরোপে পরমাণুবাদ সৰ্ব্বত্র গৃহীত। এই পরমাণুবাদ আমাদের ভূমিতেই সৰ্ব্ব প্রথমে আবিষ্কৃত হইয়াছে। ভারতীয় আস্তিক ষড়দর্শনের মধ্যে অন্যতম দর্শন হলো বৈশেষিক দর্শন। এই দর্শনের ‘পদার্থতত্ত্ব’ বা ‘বিশ্বতত্ত্বে’র জ্ঞানপ্রাচীনকালে যে কোন ছাত্রের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করা হতো। বিশ্বতত্ত্বের আলোচনাই বৈশেষিক দর্শনের প্রধান আলোচনা। ন্যায়-সম্প্রদায়ের মতো বৈশেষিক সম্প্রদায়ও মোক্ষকেই পরমপুরুষার্থ বলে মনে করেন। ন্যায় দর্শনে যেমন ষোড়শ পদার্থের তত্ত্বজ্ঞানকে মোক্ষের হেতুরূপে গণ্য করা হতো, বৈশেষিক দর্শনে তেমনি দ্রব্যাদি সপ্তপদার্থের সাধর্ম্য বা বৈধর্ম্যহেতুক তত্ত্বজ্ঞানকেই মোক্ষেরহেতুরূপে গণ্য করা হয়।


প্রমান ও ব্যাখা

 বৈশেষিক সূত্র, মহর্ষি কণাদের আজ হতে প্রায় ২৫০০ বছর আগের আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-২য় শতকের লেখা বৈশেষিক দর্শনের কালজয়ী গ্রন্থ।এই গ্রন্থের ৫ম অধ্যায়ে মহর্ষি কণাদ আলোচনা করেছেন বস্তুর উপর প্রযুক্ত বল ও তার গতিপথ,বস্তুর পতন ও তার উপর অভিকর্ষ বলের প্রভাব নিয়ে।শংকর মিশ্রখ্রিষ্টীয় ৭ম শতকে মহর্ষি কণাদের এই কালজয়ী গ্রন্থের ভাষ্য রচনা করেছেন উপাস্কর নামে। প্রায় ২২০০ বছর আগে ঋষি কণাদ কি বলেছিলেন,কিভাবে করেছিলেন অভিকর্ষ বলের অবতারণা আর দেখব কণাদের শ্লোক নিয়ে শংকর মিশ্রের ভাষ্য।


কণাদ-"সংযোগাভাবে গুরুত্বাত্ পতনম্"বাইরের কোন শক্তির প্রভাব ব্যাতিত একটি বস্তুর পতন হতেই থাকবে।(বৈশেষিক সূত্র,অধ্যায় ৫,আহ্নিক ১,শ্লোক ৭)

আপেল গাছের নিচে বই পড়ার সময় একটি আপেল নিচে পতিত হবার সূত্র ধরে মহাবিজ্ঞানী নিউটনের মহাকর্ষ বল আবিস্কারের সেই বিখ্যাত গল্প আমরা জানি।খেয়াল করেদেখবেন প্রথম শ্লোকটির ছবিতে,৭ম শতকে শংকর মিশ্র পতনশীল বস্তুর অভিকর্ষ বলের উদাহরণ দিতে গিয়ে পতনশীল ফলের কথা বলেছেন।৭ম শতকের শংকর মিশ্র আর ষোড়শ শতকের নিউটন,বয়সের পার্থক্যটা ৮০০ বছরের হলেওচিন্তার মিলটা বড়ই অদ্ভূত।


নিউটনের প্রথম সূত্র যেন কি ছিল?


নিউটনের প্রথম সূত্র: বাইরে থেকে কোন বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থির এবং গতিশীল বস্তু সুষম গতিতে  চলতেই থাকে।


কণাদ-"নোদনবিশেষাভাবাত্নোদ্র্ধ্বং ন তির্য়জ্ঞমনম্"(শ্লোক ৮)বাইরে থেকে বিশেষ শক্তি(নোদন বিশেষ) না থাকলে বস্তু উপরে,তীর্যক অর্থাৎ পাশাপাশি  কোন দিকে(তিনদিকের কোন দিকেই কেবল নিচের দিক ছাড়া) যেতে পারেনা।

নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র: কোন বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক এবং"বল যে দিকে ক্রিয়া করে বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তন সেদিকেই ঘটে।" অর্থাৎ বলের প্রভাবেই বস্তু নির্দিষ্ট দিকে গতিশীল হয়।


কণাদ-


"প্রযত্ন বিশেষত্নোদন বিশেষঃ"(শ্লোক ৯)।


বিশেষ বলে কাজ হলে(প্রযত্ন বিশেষ) তার বিপরীত কাজও(নোদন বিশেষ) ঘটিত হইবে।

নিউটনের তৃতীয় সূত্র: প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে৷

আর আজ হতে ২৬০০ বছর আগে,খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে প্রাচীন ভারতীয় আর্যবিজ্ঞানীব্রহ্মগুপ্তপ্রথম এই অভিকর্ষ বল বা গুরুত্বাকর্ষণম্ এর কথা সূত্র হিসেবে তুলে ধরেন।তিনি বলেন-" পৃথিবীপৃষ্ঠ সকল দিকেই একই,এর উপরেই আমরা দাঁড়িয়ে থাকি,সকল ভরযুক্ত পদার্থ প্রকৃতির নিয়মেই ভূ্মির দিকে পতিত হয়,যেমন জলের ধর্ম প্রবাহিত হওয়া তেমনি ভূমিরও ধর্ম বস্তুকে আকর্ষণ করা।...


মহর্ষি কণাদের জড়পদার্থের জ্ঞান সম্বন্ধে সমধিক দৃষ্টি ছিল। সেই জন্যই তিনি পরমাণুবাদ স্থাপন করেন। মেঘ, বিদ্যুৎ, বজ্রাঘাত, ভূমিকম্প, করকা, হিমশীলা, বৃক্ষের রস সঞ্চার, চুম্বক ও চুম্বকার্ষণ, গতি, জড়ের সংযোগ ও বিয়োগাদি গুণ ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে তাঁহার চিন্তা ধারা ধাবিত হইয়াছিল। বড়ইদুঃখের বিষয় যে পরবর্ত্তীকালে আর কোনও পণ্ডিতের দৃষ্টি এইদিকে আকৃষ্ট হয় নাই। আর বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় তৎক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয় ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ-কোটি পুস্তক ধ্বংস করা হয়েছিল, যার জন্য আমরা পিছিয়ে গিয়েছি জ্ঞান-বিজ্ঞানে। সুতরাং জড়বিজ্ঞানের উন্নতি ভারতবর্ষে আর হইল না। গ্ৰীসদেশীয় পণ্ডিত ডেমক্রিটাস ইউরোপে প্রথম পরমাণুবাদ আবিষ্কার করেন। তিনি কণাদের পরবর্তী।


কণাদ সম্পর্কে আরো জানা যায়:

(১) জৈনদর্শনাচার্য্য। তিনি জৈনমতে বৈশেষিকদর্শন প্রণয়ন করেন। তাঁহার গুরুর নাম রোহ গুপ্ত। তিনি খ্ৰীঃ পূঃ ৭১ অব্দে বৰ্ত্তমান ছিলেন।


(২) কণাদ নামে একজন জ্যোতিষ সংহিতার রচয়িত ও ছিলেন।


(৩) তিনি নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ পণ্ডিত বাসুদেব সাৰ্ব্বভৌমের অন্যতম ছাত্র। তিনি ‘অনুমান মণি ব্যাখ্যা’ গ্রন্থের রচয়িতা। খ্ৰীঃ চতুর্দ্দশ শতাব্দীর শেষভাগে তিনি বর্ত্তমান ছিলেন।


"আর্যভারত শুরু করেছিল হাজার হাজার বছর আগে,আজ জ্ঞানের সে মশাল এগিয়ে নিয়ে চলেছে ইউরোপ আমেরিকার সৈনিকরা।আর আর্য ভারত আজ শ্রীরাম ও শ্রীকৃষ্ণের মত তার বীর সন্তানদের নামে আজগুবি বানানো গল্প ফেঁদে ভক্তির ব্যবসা করে খাচ্ছে,বিজ্ঞান আজ চলে গেছে পেছনে।প্রাচীন গৌরব স্মরণ করেই তাই ক্ষান্ত হবার উপায় নেই,তাকে অনুসরণ করে  সামনে এগিয়ে চলুন বেদের পথ ধরে।


তথ্যসূত্র:


1. Wikisource


2. বৈদিক সনাতন হিন্দু


3. অগ্নিবীর

Post a Comment

উপরের তথ্যটি সম্পর্কিত আপনার কোন জিজ্ঞাসা আছে? বা এর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে এমন কোন বিষয় জানার আছে? থাকলে অবশ্যই সুরুচিপূর্ণ কমেন্ট করে জানান, আমরা নিশ্চয়ই আপনাকে বিষয়টি জানানোর চেষ্টা করব এবং এতে উভয়ের জ্ঞানের প্রসার ঘটবে।

Previous Post Next Post