যেকোন ধরণের ধর্মীয় প্রশ্নের উত্তর জানতে বামে মেজেজ্ঞার আইকনে ক্লিক করে আমাদের প্রশ্নটি লাইভ চ্যাটের মাধ্যমে জানান, SanatanLive.blogspot.com

মূর্তিপূজা

সনাতনধর্ম মতে মূর্তিপূজা বলে কিছু হয় না, হিন্দুরা যে পূজা করে তা আসলে প্রতিমাপূজা। (আসলে ঠিক তাও যে নয়, তা পরে বোঝা যাবে।)  হিন্দুধর্মে প্রতিমা আর মূর্তির মধ্যে পার্থক্য করা হয়। কোনো বস্তুর মধ্যে যখন ভগবানের অস্তিত্ব আহ্বান করা হয় এবং তাকে স্বয়ং ভগবানের প্রতীক মনে করা হয় তখন তাকে 'প্রতিমা’ অথবা ‘শ্রীবিগ্রহ' বলে। অর্থাৎ আপনার শোকেসে যেটা রাখা আছে সেটা অবশ্যই মূর্তি, কিন্তু যে মুহূর্তে বিশেষ পূজার মাধ্যমে তার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয় সেই মুহূর্ত থেকে সেটা হয়ে যায় শ্রীবিগ্রহ। এটা হিন্দুধর্মের আচার-বিশ্বাস।

 

প্রতিমাপূজা হলো প্রতীকের মাধ্যমে বিশেষভাবে প্রার্থনা করা।  বিশেষভাবে শ্রদ্ধার সাথে সৃষ্টিকর্তার শক্তির আহ্বান করাকেই পূজা বলে। যেমন, নির্বাচনে কোনো একটি প্রতীককে ভোট দেয়া হয়, যার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে কোনো দল বিজয়ী হয় এবং দলের প্রধান তার মাধ্যমেই সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান হন। এখানে যেমন সত্যিকার অর্থে প্রতীক বা অন্য কোথাও ভোট দেওয়া হয় না, তেমনি কোন ছবি, কাগজ বা প্রতীকের নয়, পূজা করা হয় দেবদেবীর, চূড়ান্ত অর্থে ঈশ্বরের গুণ ও আদর্শকে।


যারা প্রতিমা পূজা নিয়ে বিতর্ক করেন তাদের দর্শন বুঝার পরই এই বিষয়টি বুঝবে। তাই অজানাকে জানতেও নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে ধৈর্য সহকারো সম্পূর্ণ পড়ুন।




+ সহজভাবে বলতে গেলে " পৃথিবীর প্রতিটি দেশেরই একটি করে জাতীয় পতাকা আছে। এই দেশগুলির পতাকা বা মানচিত্র দেখলে যেমন ঐ দেশের কথা মনে পড়বে আর দেশটাকে চিনতে পারবেন।(জাতীয় পতাকা আর মানচিত্র ঔ দেশগুলির প্রতীক) ঠিক তেমনি প্রতিমাও হল ঈশ্বরের বিশেষ / আংশিক শক্তির অংশ বা প্রতীক।" 


+সাধারণ অর্থে স্মৃতিফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ হলো এমন একটি বস্তু যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা ঘটনাকে স্মরণ করা হয়। নামফলক, সমাধিক্ষেত্র, কবরফলক, ভাস্কর্য, গণকবর, বধ্যভূমি থেকে শুরু করে দেয়াল, ভবন, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা, পার্ক যেকোনো কিছুই স্মৃতিচিহ্ন বা স্মৃতিসৌধ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে।


স্মৃতিসৌধ শুধু মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের স্মৃতি স্মরণের জন্যই নয়, এর মধ্যে যে লুকিয়ে আছে আমাদের আরো ইতিহাস তা সবার জানা থাকা ভালো। কারণ যে ইতিহাস, যে ঘটনা আমাদের স্বাধীনতার পথে স্বল্প সময়ে ও দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা হয়ে উঠেছি অপ্রতিরোধ্য। একটি স্বাধীন দেশের নেশায় বাংলার নারী-পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে, ছিনিয়ে এনেছে বিজয়। তাই আমরা স্মৃতিসৌধের মাধ্যমে কোন ইট পাথরকে নয় বরং বীর শহীদের ও বাঙ্গালি জাতির বীরত্বের ইতিহাসকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করি।


আবার সমাধি বা চিতার স্থানে যে মানুষটির শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে সেই জায়গার একটা চিহ্ণ বা আকার দেওয়া হচ্ছে, পরবর্তীতে সেই মানুষটার মঙ্গল কামনায় সেই জায়গায় গিয়ে তার উদ্দেশ্যে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করতেছেন বা ঐ স্থান বা চিহ্ন কে প্রণাম করে আশির্বাদ চাইতেছেন। মূলত আপনি এই চিহ্ন বা স্তম্বের মাধ্যমে ঐ ব্যক্তিকেই স্মরণ করতেছেন।


মন্দির বা উপসনালয়কে সম্মানের চোখে দেখতেছেন, স্রষ্ট্রার উপসনালয় বা ঘর হিসাবে, ইট বা বালু দিয়ে তৈরির দালানের জন্য নয়।


ঠিক তেমনি হিন্দুরাও নিরাকার পরমাত্মার গুণ বা শক্তিকে সাকার প্রতীক বা স্রষ্টার যেকোন  সাকার সৃষ্টিকে - সমস্ত প্রকৃতিকে স্রষ্ট্রার অংশ হিসেবে মূলত নিরাকার পরমাত্নাকে পূজা করে। কোন মাটি বা পাথর বা খড়খুটো লক্ষ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মানুষই কোন না কোন ভাবে প্রকৃতির পূজারী।



স্বামী বিবেকানন্দ  বলেছিলেন, ‘পুতুল পূজা করে না হিন্দু, কাঠ, মাটি দিয়ে গড়া মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে হয়ে যায় আত্মহারা।’ ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে  বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে মূর্তিপূজা সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘Hindus are not idol-worshipers. They are ideal-worshipers.’ অর্থাৎ, হিন্দুরা মূর্তি পূজারী নন, তারা আদর্শের পূজারী। মূর্তি হল একটি আদর্শের প্রতীক।


প্রথমেই বলে রাখা দরকার সনাতন দর্শনে বহু ঈশ্বরবাদের স্থান নাই বরং আমরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। হিন্দু শাস্ত্র মতে, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। সনাতন দর্শন বলে, ঈশ্বর স্বয়ম্ভূ অর্থাৎ ঈশ্বর নিজে থেকে উৎপন্ন, তার কোন স্রষ্টা নাই, তিনি নিজেই নিজের স্রষ্টা। প্রাচীন ঋষিগণ বলে গিয়েছেন, ঈশ্বরের কোন নির্দিষ্ট রূপ নেই (নিরাকার ব্রহ্ম) তাই তিনি অরূপ, তবে তিনি যে কোন রূপ ধারণ করতে পারেন। কারণ তিনিই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সর্ব ক্ষমতার অধিকারী। ঋগ্বেদে বলা আছে ঈশ্বর ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’- ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। ঈশ্বর সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে তিনি ‘অবাঙ্মানসগোচর’ অর্থাৎ ঈশ্বরকে কথা (বাক), মন বা চোখ দিয়ে ধারণ করা যায় না, তিনি বাহ্য জগতের অতীত। ঈশ্বর সম্পর্কে আরো কিছু উদ্ধৃতি-


১. ছান্দোগ্য উপনিষদের ৬ নম্বর অধ্যায়ের ২ নম্বর পরিচ্ছেদের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে- ‘একাম এবাদ্বিতীইয়ম।’ অর্থ- ‘স্রষ্টা মাত্র একজনই দ্বিতীয় কেউ নেই।’


২. শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ৬ নম্বর অধ্যায়ের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে- ‘না চস্য কসুজ জানিত না কধিপহ।’ অর্থ- ‘সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরের কোন বাবা-মা নেই, তাঁর কোন প্রভু নেই, তাঁর চেয়ে বড় কেউ নেই।’


৩. ‘একং সদ বিপ্র বহুধা বদন্তি’ (ঋগ্বেদ, ১/১৬৪/৪৬) অর্থাৎ ‘সেই এক ঈশ্বরকে পণ্ডিতগণ বহু নামে ডেকে থাকেন।’


৪. যজুবেদের ৩২ নম্বর অধ্যায়ের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে- ‘ ন তস্য প্রতিমা অস্তি য়স্য নাম মহদ্ য়শঃ।

 হিরণ্যগর্ভ ইত্যেষ মা মা হিংসীদিত্যেষা য়স্মান্ন জাত ইত্যেষঃ।।

অনুবাদ: যাঁর মহান প্রসিদ্ধ যশ রয়েছে সেই পরমাত্মার কোনো প্রতিমা নেই।


৫. যজুবেদের ৪০ নম্বর অধ্যায়ের ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে, ‘সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নিরাকার ও পবিত্র।’


৬. ‘একং সন্তং বহুধন কল্পায়ন্তি’ (ঋগ্বেদ, ১/১১৪/৫) অর্থাৎ ‘সেই এক ঈশ্বরকে বহুরূপে কল্পনা করা হয়েছে।’


৭. ‘দেবানাং পূর্বে যুগে হসতঃ সদাজায়ত’ (ঋগ্বেদ, ১০/৭২/৭) অর্থাৎ ‘দেবতারও পূর্বে সেই অব্যক্ত (ঈশ্বর) হতে ব্যক্ত জগত উৎপত্তি লাভ করেছে।’


৮. যজুর্বেদের ৪০.১, ‘এই সমস্ত বিশ্ব শুধু মাত্র একজন ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্টি ও পরিচালিত হচ্ছে। ”যিনি কখনই অন্যায় করেন না অথবা অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জনের ইচ্ছা রাখেন না।


৯. ঋগ্বেদ ১০.৪৮.৫, ‘ঈশ্বর সমস্ত পৃথিবীকে আলোকিত করেন। তিনি অপরাজেয় এবং মৃত্যুহীন ও এই জগতের সৃষ্টিকারী।’


১০.  যজুর্বেদ সংহিতা ৩২.১১, ‘ঈশ্বর যিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর মধ্যে তিনি অধিষ্ঠিত।’


১১. ঋগ্বেদ সংহিতা ১০.৪৮.১ ‘ঈশ্বর যিনি সর্ব্বত্রই ব্যাপ্ত আছেন।’


১২. “ঈশ্বর সকল ভূতপ্রাণীর হৃদয়ে বাস করেন” – শ্রীমদভগবদগীতা-১৮/৬১


দেবদেবীগণ ঈশ্বর নন। ঈশ্বরকে বলা হয় নির্গুণ। অর্থাৎ জগতের সব গুণের (Quality) আধার তিনি। আবার ঈশ্বর সগুণও কারণ তিনি সর্বশক্তিমান। ঈশ্বর চাইলেই যে কো্নো গুণের অধিকারী হতে পারেন এবং সেই গুণের প্রকাশ তিনি ঘটাতে পারেন। দেবদেবীগণ ঈশ্বরের এই সগুণের প্রকাশ। অর্থাৎ ঈশ্বরের একএকটি গুণের সাকার প্রকাশই দেবতা। ঈশ্বর নিরাকার কিন্তু তিনি যেকোনো রূপে সাকার হতে পারেন, কারণ, তিনি সর্বক্ষমতার অধিকারী। 


যদি আমরা বিশ্বাস করি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, তাহলে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার গুনের প্রকাশ খুবই স্বাভাবিক।


তাই, ঈশ্বরের শক্তির সগুন রূপ- কালী, নবদুর্গা, কার্তিক ইত্যাদি।

বিদ্যা-সিদ্ধির সগুন রূপ- সরস্বতী, গণেশ ইত্যাদি।

ঐশ্বর্যের সগুন রূপ- লক্ষ্মী, কূবের ইত্যাদি।

মৃত্যুর সগুন রূপ- কালভৈরব, ভূতনাথ, যম ইত্যাদি।

তেমনি ঈশ্বর যখন সৃষ্টি করেন তখন ব্রহ্মা (দেব)

যখন পালন করেন তখন বিষ্ণু (দেব)

আর (প্রলয়রূপে) /( ধ্বংস) করেন শিব (দেব)


তিনি যখন আলোপ্রদান করেন তখন তিনি- সূর্য ও চন্দ্র

তিনি আবার পঞ্চ ভূত- ক্ষিতি, অপ, মরুৎ, বোম, তেজ

এই ভাবে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার গুনের প্রকাশ হয়।


ঐতরেয় উপনিষদ ১.১ তে বলা আছে-

“সৃস্টির পূর্বে একমাত্র পরমআত্মা ছিল এবং সবকিছু ঐ পরমআত্মার মধ্যে স্থিত ছিল, সেই সময় দৃশ্যমান কিছুই ছিলনা। তখন পরমআত্মা স্বয়ং চিন্তা করলেন, আমি, আমি হইতে এই জগৎ নির্মাণ করব”

এর জন্য বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে সবই এক ঈশ্বরের অংশ। আর এই এক-একটি অংশ হল এক-একটি দেবদেবী।


সনাতন দর্শনে বর্ণনা আছে ব্রহ্মান্ডে, ব্রহ্মা আমাদের সৃষ্টিকর্তা ( উল্লেখ্য ব্রহ্মা সাকার, কিন্তু ঈশ্বর বা ব্রহ্ম নিরাকার), বিষ্ণু পালনকর্তা, শিব ধ্বংস কর্তা)

পরমেশ্বর ভগবানের বিশ্বরুপ দর্শন


 যদি আমরা ভগবান শ্রী কৃষ্ণের বিশ্বরূপের ছবিটি দেখী, তাহলে খুব সহজে এটা বুঝে যাব। শ্রী কৃষ্ণের বিশ্বরূপের যতকটা মস্তক আছে, প্রতিটি মস্তক এক একটি দেবতা প্রকাশ করে অর্থাৎ  ঈশ্বরের এক একটি গুনের প্রকাশ করে। এবার প্রশ্ন তাহলে কয়টা মস্তক ছিল ?


অর্জুন এখানে বলেছিল শ্রী কৃষ্ণের বিশ্বরূপের কোনো সীমা ছিল না অর্থ্যাৎ তার শুরু আর শেষ ছিলনা অর্থ্যাৎ অসীম, এটাই হল ঈশ্বরের নির্গুণা হবার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কারণ ঈশ্বরের গুনের সংখ্যা অসীম অর্থ্যাৎ  নির্গুণা।

এজন্য বলা হয়ে থাকে ঈশ্বরই ব্রহ্মা, তিনিই বিষ্ণু, তিনিই শিব এইভাবে।


তাহলে আমারা এখন বুঝতে পারছি দেবদেবী অনেক হতে পারে কিন্তু ঈশ্বর এক এবং দেবতাগণ এই পরম ব্রহ্মেরই বিভিন্ন রূপ। এখানে ২ টি দেবের উদাহরণ দিচ্ছি ব্যাপারটা ভালো ভাবে বোঝার জন্য-

(১)বিষ্ণু , বিষ্-ধাতু থেকে উৎপত্তি যার অর্থ ব্যাপ্তি, অর্থ্যাৎ “সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছেন যিনি” এক কথাই “সর্ব্বং বিষ্ণুময়ং জগৎ” মানে সমগ্র জগৎ বিষ্ণুময়। এবার আমার প্রশ্ন কে সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছেন?  উওর ভগবান বা ঈশ্বর , ঋগবেদ সংহিতা -১০.৪৮.১ “ভগবান যিনি সর্ব্বত্রই ব্যাপ্ত আছেন”।

(২)শিব, শী-ধাতু থেকে উৎপত্তি যার অর্থ শয়ন, অর্থ্যাৎ যিনি সবকিছুর মধ্যে শায়িত বা অধিষ্ঠিত। এবার আমার প্রশ্ন কে সবকিছুর মধ্যে শায়িত বা অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন?  উওর ভগবান বা ঈশ্বর , যজুর্বেদ সংহিতা -৩২.১১ “ভগবান যিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর মধ্যে তিনি অধিষ্ঠিত”.


লক্ষ করুন : দেবী দূর্গা, দেবতারা যখন তাকে আহব্বান করে তখন ঈশ্বরের বিশেষ শক্তি নিরাকার থেকে সাকার রুপ ধারণ করে, পরে কার্য সম্পদানের পর তিনি আবার নিরাকারেই মিশে যান।



তাই হিন্দুরা বহু দেবোপাসক(বস্তুত দেবোপাসনা ঈশ্বর উপাসনাই) হতে পারে তবে বহু ঈশ্বরবাদী নন।

এতক্ষন আপনাদেরকে বললাম ঈশ্বর আর দেবতার পার্থক্য। এখন বলব তাহলে আমরা কেন এ সকল দেব দেবীগণের মূর্তি পূজা করি।


মূর্তিপূজার রহস্যঃ

সনাতনশাস্ত্র মতে মানুষ কখনোই ঈশ্বরের বিশালতা বা অসীমতাকে তার সসীম চিন্তা দিয়ে বুঝতে পারবে না। বরং সর্বগুণময় ঈশ্বরের কয়েকটি বিশেষ গুণকেই বুঝতে পারবে। আর এ রকম এক একটি গুণকে বুঝতে বুঝতে হয়ত কোন দিন সেই সর্ব গুণময়কে বুঝতে পারবে। আর মূর্তি বা প্রতিমা হল এসকল গুণের রূপকল্প বা প্রতীক। এটা অনেকটা গণিতের সমস্যা সমাধানের জন্য ‘x’ ধরার মতো। আদতে x কিছুই নয় কিন্তু এক্স ধরেই গণিতের সমস্যার উত্তর পাওয়া যায়। 


অথবা ধরুন জ্যামিতির ক্ষেত্রে  কোনো কিছু বিন্দু দিয়ে শুরু করা হয়। কিন্তু বিন্দুর সংজ্ঞা হলো যার দৈর্ঘ, প্রস্থ ও বেধ নাই, কিন্তু অবস্থিতি আছে- যা আসলে কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ এই বিন্দুকে আশ্রয় করেই প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা থেকে হিমালয়ের উচ্চতা সব মাপা যায়। 

আবার ভূগোল পড়ার সময় একটি গ্লোব রেখে কল্পনা করা হয় এটা পৃথিবী। আবার দেয়ালের ম্যাপ টানিয়ে বলা হয় এটা লন্ডন, এটা ঢাকা, এটা জাপান। কিন্তু ওই গ্লোব বা ম্যাপ কি আসলে পৃথিবী? অথচ ওগুলো দেখেই পৃথিবী চেনা যায়। 


তেমনি মূর্তির রূপ কল্পনা বা প্রতিমা স্বয়ং ঐসকল দেবতা নন তাঁদের প্রতীক, চিহ্ন বা রূপকল্প। এগুলো রূপকল্প হতে পারে কিন্তু তা মনকে স্থির করতে সাহায্য করে এবং ঈশ্বরের বিভিন্ন গুন সম্পর্কে ধারনা দেয়, শেখায় ঈশ্বর সত্য। সব শেষে পরম ব্রহ্মের কাছে পৌছাতে সাহায্য করে। হিন্দু ধর্মে পূজা একটি বৈশিষ্ট্য। কল্পনায় দাড়িয়ে সত্য উত্তরণই পূজার সার্থকতা। আমাদের ধর্মে ঈশ্বরের নিরাকার ও সাকার উভয় রূপের উপাসনার বিধান আছে।নিরাকার ঈশ্বরের কোন প্রতিমা নাই, থাকা সম্ভবও না। যারা ঈশ্বরের অব্যক্ত বা নিরাকার উপাসনা করেন তাঁদের বলে নিরাকারবাদি। আর যারা ঈশ্বরের সাকার রূপের উপাসনা করেন তাঁরা সাকারবাদি। এজন্য গীতায় বলা আছে, যারা নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন তারাও ঈশ্বর প্রাপ্ত হন।তবে নির্গুণ উপাসকদের কষ্ট বেশি। কারণ নিরাকার ব্রহ্মে মনস্থির করা মানুষের পক্ষে খুবই ক্লেশকর। কিন্তু সাকারবাদিদের সাকার ভগবানের উপর মনস্থির করা তুলনামূলক ভাবে সহজ। এই সাকার ভগবানের চাহিদা মেটাই “মূর্তি” গুলো। এছাড়া এই মূর্তিগুলি আমাদের পরম ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ ও কার্যকারীতা সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, ২ টি উদাহরণ দিচ্ছি ভালো ভাবে বোঝার জন্য –


(১)ব্রহ্মার ৪টি মাথা কেনো?  কারন ভগবানের ঐ গুণবাচক নাম ব্রহ্মা অর্থ্যাৎ স্রস্টা যিনি ৪টি বেদের উৎপত্তি করেছিলেন , এই গুনটিকে বোঝাবার জন্য ব্রহ্মার মূর্তিতে ৪টি মস্তক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পূর্বে বেদ একটি ছিল পরে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস ঐ একটি বেদ কে, তাদের গুরুত্ব অনুসারে বিভাজন করে ৪টি বেদে পরিণত করেন, তাই বর্তমান ধারণা অনুসারে ব্রহ্মার ৪টি মাথা দেওয়া হয়েছে, এই ৪টি মাথা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে ৪টি বেদের ব্যাপারে। আরো বিস্তারিত ব্যাখা আছে অন্য টপিকে জানবেন।


(২)শিবের তিনটি চোখ কেনো? কারন ভগবানের ঐ গুণবাচক নামে ৩টি গুণ-সত্ত্বঃ,রজোঃ ও তমোঃ প্রকাশ হচ্ছে। এর জন্য শিবের মূর্তিতে তিনটি চোখ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভগবান তো নির্গুণা, এখানে তিনটি চোখ এটাই বোঝাচ্ছে পরম ভগবান এই গোটা জগৎ কে এই ত্রিগুণ-সত্ত্বঃ, রজোঃ ও তমোঃ দিয়ে নির্মান করেছেন। অর্থ্যাৎ এই সম্পূর্ণ জগৎ তিনটি গুনের আধারে তৈরী।

আরো বিস্তারিত ব্যাখা আছে অন্য টপিকে জানবেন।


+ যেমন ধরেন নবগ্রহ হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রের কিছু পরিচিত প্রতীক ৷ এই নয়টি প্রতীক যা , সৌরজগতের গ্রহসমূহের সাথে তুলনীয় ৷ যেমন :সূর্যদেব(সূর্য), চন্দ্রদেব(চন্দ্র), মঙ্গলদেব(মঙ্গল), বুধদেব(বুধ), বৃহস্পতি(বৃহস্পতি গ্রহ), শুক্র(শুক্র গ্রহ), এবং শনিদেব(শনি), রাহু ও কেতু ৷


আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে থেকে হিন্দুরা এগুলোর পূজা করে, ঔষধি গাছ সহ প্রচীন মহর্ষিরা তাদের আবিষ্কৃত জ্ঞান-বিজ্ঞানকে এরকম প্রক্রিয়ায় জীবিত রেখেছেন, যাতে এগুলি মানুষের উপকারে আসে, সহজে হারিয়ে না যায়। এমনকি দেশ, মাটি, প্রকৃতির সব ভাল কিছুই পূজনীয় হিন্দুদের কাছে।


তবে কি হিন্দুরা পৌত্তলিক ?

অন্য ধর্মের লোকেরা সনাতন দর্শন সম্পর্কে না জেনেই মূর্তি পূজা দেখে মন্তব্য করে বসেন হিন্দুরা পৌত্তলিক। কিন্তু সঠিক দর্শন জানলে তাঁদের এ ভুল ধারনা ভাঙবে।আগেই বলেছি আমাদের দেবতা অনেক কিন্তু ঈশ্বর এক।ঈশ্বরের কোন প্রতিমা নেই। দেবতারা হলেন ঈশ্বরের এক একটি রূপের বা গুনের প্রকাশ।মূর্তি বা প্রতিমা হল সে সকল গুনের প্রতীক, চিহ্ন বা রূপকল্প। সব সম্পদায়ের এমন রূপকল্প, চিহ্ন বা প্রতীক আছে, যা তাঁদের কাছে পবিত্র। 


কেউ কেউ শুন্যপানে চেয়ে প্রার্থনা করে। তাহলে কি ঐ শুন্যপানে ঈশ্বরের বসতি ? আসলে তা নয়। আমি আগে বলেছি ঈশ্বর সর্বস্থানে বিরাজমান। এটা তাদের স্বীয় বিশ্বাস, যে আকাশে ঈশ্বরের বসতি। এভাবে যদি চিন্তা করা হয়,তাহলে দেখা যায় জগতের সবাই পৌত্তলিক।


এই প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের একটি ঘটনার কথা বললে আপনারা ভালো ভাবে বুঝতে পারবেন।

পরিব্রাজক স্বামী বিবেকানন্দ তখন আলোয়ারের মহারাজের অতিথি । আলোয়ার রাজ কথা প্রসঙ্গে স্বামীজিকে জানালেন যে মূর্তি পূজায় তিনি বিশ্বাস করেননা । স্বামীজি একথা শুনে মহারাজার একটি চিত্র আনতে বললেন এবং রাজার দেওয়ানকে বললেন ওই ছবির উপর থুথু ফেলতে ।সমস্ত রাজসভা নিঃশব্দে এই দৃশ্য দেখতে লাগল । দেওয়ান স্বামিজির নির্দেশ পালনে অসমর্থ হলেন, তখন স্বামীজি বললেন, এই ছবি তো একটি রং করা কাগজ মাত্র, এই ছবি তো আর রাজা নয়, তাহলে এর উপর থুথু ফেলতে অসুবিধা কোথায় ? স্বামীজির বারংবার নির্দেশ সত্ত্বেও দেওয়ান যখন রাজার ছবিতে থুথু ফেলতে পারলেননা।

তখন স্বামীজি রাজাকে বুঝিয়ে বললেন, ফটোগ্রাফ তো একটি জড়বস্তু, একখণ্ড রং করা কাগজ মাত্র । তবু ওই ছবিটি আসল মানুষটিকে মনে করিয়ে দেয় । ছবিটির দিকে দেখলে আমরা ভাবিনা, যে নিছক কোনও রং করা কাগজ দেখছি । ঠিক তেমনই আমরা যখন মাটির মূর্তি পূজা করি আমরা মনে করি স্বয়ং ভগবানকেই পূজা করছি । আমরা সে সময় কখনও মনে করিনা আমরা কোনও জড় মূর্তি বা খড় বা মাটির উপাসনা করছি, আমরা দেবতার মূর্তিকে শুধুমাত্র প্রতীক মনে করি এর বেশি কিছু নয়। এজন্য পূজার সময় পূজারী ব্রাহ্মণগন মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন অর্থাৎ ধরে নেয়া হয় দেবতাগন ঐ প্রতিমায় ভাস্বর হয়ে উঠবেন।যদি মন্ত্রটির সংস্কৃত কে বাংলা করেন তো বুঝবেন মন্ত্রে কেবল পরম ঈশ্বরের ঐ সাকার গুণটিকে(দেবতা) বিভিন্ন ভাবে অনুরোধ করছে, ঐ মাটির মূর্তিতে স্থাপন হবার জন্য।


আবার কাঠমাটির প্রতিমা যে ঐ সকল দেবতা নয়, তার প্রমান মেলে পূজার পর প্রতিমা গুলোকে জলে বিসর্জন দিয়ে, যদি প্রতিমাকেই ঐ সকল দেবতা মনে করা হত তাহলে নিশ্চয় কেউ তা জলে বিসর্জন দিত না!


সম্পর্কিত তথ্য : এখানে ক্লিক করে "প্রতিমা বিসর্জনের তাৎপর্য" পড়ুন ও জানুন


তাই হিন্দুরা দেবমূর্তি পুতুল নয়, তা চিন্ময় ভগবানেরই প্রতীক। সনাতন ধর্মে ঈশ্বরের নিরাকার ও সাকার উভয় রূপের উপাসনার বিধান আছে। যারা ঈশ্বরের অব্যক্ত বা নিরাকার উপাসনা করেন তাঁদের বলে নিরাকারবাদি। আর যারা ঈশ্বরের সাকার রূপের উপাসনা করেন তাঁরা সাকারবাদি।

এজন্য স্বামী বিবেকানন্দের বলেছেন- “পুতুল পূজা করে না হিন্দু, কাঠ মাটি দিয়ে গড়া, মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে, হয়ে যাই আত্মহারা’’

এখন প্রশ্ন আসতে পারে আমরা কেন তাহলে নিরাকার ঈশ্বরের পূজা না করে সাকার ঈশ্বরের পূজা করি?

জাগতিক মোহ থেকে সাকার পূজা করা হয়ে থাকে। আগেই বলেছি যে বিদ্যা চায়, তাহলে সে সরস্বতী দেবীর প্রার্থনা করে,  যে অর্থ চায় সে লক্ষ্মী দেবীর প্রার্থনা করে, তেমনি যে বিভিন্ন বাধা বিপত্তি থেকে উদ্ধার চায় সে কালী পূজা করে। এজন্য গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, 


শ্রীমদভগবদগীতা ৭.২০

শ্লোক-

“কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ।

তাং তাং নিয়মমাস্থায় প্রকৃ্ত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।”

অনুবাদ-

“জড় কামনা-বাসনায় দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে তারা অন্য দেবদেবতার শরণাগত হয় এবং তাদের স্বীয় স্বভাব অনুসারে বিশেষ নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করে”

মানুষ মাত্রই জড় কামনা-বাসনা দ্বারা জড়িত তাই তারা মূর্তি নির্মিত দেবতাদের উপাসনা করছে ও করবেও ।দেবতার রূপ ও গুন মানুষের বিচিত্র রুচিকে তৃপ্ত করে ও চঞ্চল মনকে অচঞ্চল করতে সহায়তা করে।

উদাহরণ –

একমাত্র মন্দির বা উপাসনালয়ে গেলে মনে পবিত্রতা আসে, মন প্রাশান্ত হয়,মনে ভক্তি জেগে ওঠে।অথচ ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান।তাহলে কেন শুধুমাত্র মন্দিরে গেলেই মনে বেশি ভক্তিভাব আসে।আসলে জাগতিক মোহে আবদ্ধ হয়ে আমরা ঈশ্বরের এই সর্ববিরাজমানতা ভুলে যাই।


যারা সবস্থানে ঈশ্বরের এই অস্তিত্ব অনুভব করতে পারেন তারাই নিরাকার উপাসনার যোগ্য। তেমনি একটি ছোট বাচ্চাকে কিংবা কোন অজ্ঞ ব্যক্তিকে নিরাকার ঈশ্বর সম্পর্কে ধারনা দিবেন সে বুঝবে না! বরং সে সহজে বুঝবে সাকার দেবতারূপ ঈশ্বরকে।এই সাকার রূপের প্রতিমা দেখে সহজেই বুঝতে শিখবে ঈশ্বরের গুনের কথা, শক্তির স্বরূপ সম্পর্কে ।এভাবে শুরুতে সাকার উপাসনার মধ্য দিয়েই নিরাকার উপাসনার যোগ্যতা অর্জন করতে হয় আমাদের। তাই কেউ যদি এক লাফে নিরাকারবাদি হতে চাই, তাহলে তাকে যথেস্ট আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও দার্শনিক জ্ঞান সম্পন্না হতে হবে। তবে সব কিছুই যেহেতু সেই অসীমেরই অংশ তাই শ্রদ্ধা সহকারে দেবতার পুজাও পরোক্ষভাবে ঈশ্বরের উপাসনা। এজন্য সনাতন সংস্কৃতিতে দেখা যায় শুধু মাত্র দেবতা নয় উদ্ভিদ, উপকারী প্রাণী এমনকি মনুষ্য পুজাও করে থাকেন অনেকে, এছাড়াও উপকারী উদ্ভিদ ও প্রাণীদেরও অনেক সময় উপকারীতা ব্যাক্ত করার জন্য অথবা পরিবেশের উপকারীতা ব্যাক্ত করার জন্য, তাদের কেও পূজা করা হয়ে থাকে।এটা যেমন এক দিক দিয়ে পরোক্ষভাবে ঈশ্বরের উপাসনা ও আরেক দিক দিয়ে উপকারীতা ব্যাক্ত করার একটি পদ্ধতি, এইছাড়া এতে অনেক পৌরাণিক ব্যাখা আছে ।

তবে দেবোপাসনায় কাম্য বস্তু লাভ হলেও ঈশ্বর লাভ হয় না।শুধুমাত্র পরম ঈশ্বরের উপাসনাতেই ঈশ্বর লাভ হয়। এজন্য গীতায় শ্রীকৃষ্ণ

বলেছেন- 


শ্রীমদভগবদগীতা ৯.২৫

শ্লোক-

যান্তি দেবব্রতা দেবান পিতৃন যান্তি পিতৃব্রতাঃ ।

ভূতানি যান্তি ভূতেজ্যা যান্তি মদযাজিনোহপি মাম।।

অনুবাদ-

“দেবতাদের উপাসকেরা দেবলোক প্রাপ্ত হবে, পিতৃপুরুষদের উপাসকেরা পিতৃলোক

লাভ করে, ভূত-প্রেত আদির উপাসকেরা ভূতলোক লাভ করে এবং আমার (ঈশ্বরের)উপাসকেরা আমাকেই(ঈশ্বরকে) লাভ করে”

সরল অর্থ-

হে অর্জুন! দেবোপাসকগন দেবগনকে প্রাপ্ত হয়। দেবগন পরিবর্তিত সত্তা।।


তারা নিজেদের সদকর্মানুসারে জীবন অতিবাহিত করে। পিতৃগনের পূজকগন পিতৃগনকে প্রাপ্ত হন অর্থাৎ অতীতের মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকে।ভূতোপাসকগন ভূত হন অর্থাৎ জীবদেহধারণ করেন এবং আমার (ঈশ্বরের)ভক্ত আমাকেই(ঈশ্বরকে) লাভ করেন।

এখানে মূর্তি বা ভগবত বিগ্রহ প্রতীক বটে তবে মূর্তি পূজা সম্পর্কে এটাই শেষ কথা নয়। সাধনা যাত্রার প্রারম্ভে শ্রীমূর্তি হতে পারে কিন্তু সাধনার পরিনতিতে উহা চিন্ময় সত্তা। প্রতীক রুপটি চিন্ময় রুপে পরিনতি হলেই পূজা সার্থক হয়।যিনি একদিন ছিলেন অপরিচিত লোক – তারই সঙ্গে বহু মেলামেশার পর যেমন তিনি হয়ে ওঠেন পরম বন্ধু – সেইরুপ, প্রতীক রূপে যে মূর্তির হয় প্রতিষ্ঠা, ভক্তের অর্চনার ফলে তিনিই হয়ে ওঠেন সাক্ষাৎ ভগবান। আচার্য রামানুজের কথায় যা হল “অরচ্চাবতার” এবং এই ভাবে সেই ভক্ত শ্রীমূর্তি থেকে পরম চিন্ময় সত্তা কে বোঝে এবং একসময় “সর্বভূতে ঈশ্বরের অনুভুতি লাভ করে” অর্থাৎ “পরম ঈশ্বর কে লাভ করে” অর্থাৎ  “স্ব-আত্মা সাথে পরমআত্মার সংযোগ” । শূধুমাত্র এই অংশটুকু সংঘটিত হতে সময় লাগতে পারে কয়েক দিন বা কয়েক মাস বা কয়েক বছর আবার এই জন্মেও না হতে পারে। এটা নির্ভর করে সম্পূর্ণ নিজের উপর। এই প্রসঙ্গে আচার্য রামানুজের একটি ঘটনার কথা বললে আপনারা বুঝতে পারবেন।


আরো জানুন : হিন্দু বাড়িতে তুলসী গাছ থাকে কেন


আচার্য রামানুজের কাছে একদিন এক মূর্তি পুজায় আস্থাহীন ব্যক্তি এসে উপস্থিত হন।তিনি আচার্যকে জিজ্ঞেস করেন, ব্রহ্ম বিশ্ব ব্যাপী, তাকে পূজা করার জন্য আপনি ছোট ছোট কতগুলি পিতলের মূর্তি রেখেছেন কেন? আচার্য বললেন, আমার ধুনি জ্বালাবার জন্য আগুনের দরকার, আপনি গ্রাম হতে আমাকে আগুন এনে দিন , তারপর আপনার প্রশ্নের জবাব দিব।

ঐ লোকটি একখানা কাঠে আগুণ নিয়ে উপস্থিত হলেন। আচার্য তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এক খণ্ড দগ্ধ কাঠ এনেছেন কেন? যা বলেছি তাই আনুন। আগুন বলেছি আগুন আনুন। আগুন সকল বস্তুর মধ্যেই আছে। আপনার হাত ঘষে দেখুন, হাতের মধ্যেও আগুন আছে। আপনি আমার জন্য একটু খাটি আগুন আনুন। পোড়া কাষ্ঠ চাই না।

আচার্যের কথা শুনে লোকটি বললেন, অগ্নি সব বস্তুর মধ্যেই আছে কিন্তু আপনার নিকট আনতে হলে কাষ্ঠ ছাড়া উপায় দেখি না।

তখন আচার্য বললেন, সকল বস্তুর মধ্যে নিহিত অগ্নিকে আমার নিকট আনতে হলে কাষ্ঠ ছাড়া উপায় দেখেন না- আমিও সেই রূপ সর্বভুতস্থ সর্বব্যাপী পরম ব্রহ্মকে আমার নিকটতম আনতে চাইলে, মূর্তিকে আরোপ ছাড়া উপায় দেখি না। আপনার হাতের কাষ্ঠ খানা আগে ছিল কাষ্ঠ কিন্তু তাতে অগ্নি ধরাবার পর তা হয়ে উঠেছে অগ্নি, তেমনি আমার নিকটস্থ এই ঠাকুরটি এক সময় ছিলেন পিতল নির্মিত মূর্তি এখন সেটি চিন্ময় ব্রহ্ম। ইহা সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ।নারায়ণ যেমন অযোধ্যায় এসেছিলেন রাম রূপে, তিনি আজ আমার দুয়ারে এসেছেন ‘অরচ্চাবতার’ রূপে। আচার্যের উক্তিটি জিজ্ঞাসু ব্যক্তিটির সকল সংশয় দূর করে দিল।

তাহলে কি ঈশ্বর আমাদের মূর্তিপূজা্র অনুমতি দিয়েছে ?

শ্রীমদভগবদগীতা ৭.২০

“কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ।

তাং তাং নিয়মমাস্থায় প্রকৃ্ত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।”

অনুবাদ-

“জড় কামনা-বাসনায় দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে তারা অন্য দেবদেবতার শরণাগত হয় এবং তাদের স্বীয় স্বভাব অনুসারে বিশেষ নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করে”

আমি আগেও বলেছি মানুষ মাত্রই জড় কামনা-বাসনা দ্বারা জড়িত তাই তারা মূর্তি নির্মিত দেবতাদের উপাসনা করছে ও করবেও অর্থাৎ সাকারবাদি। কিন্তু যাদের মস্তিস্ক এই জড় কামনা-বাসনা দ্বারা জড়িত নয় তারা কিন্তু মূর্তি নির্মিত দেবতাদের উপাসনা করবে না অর্থাৎ নিরাকারবাদি।তারা “সর্বভূতে ঈশ্বরের অনুভুতি লাভ করে”। আর আগেও বলেছি নিরাকারবাদি হতে গেলে তাকে যথেস্ট আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পন্না হতে হবে, যেটা একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে এক লাফে, কোনো দিনও সম্ভব নয়। তাই সাকারবাদি থেকে নিরাকারবাদির দিকে যেতে হবে।

এরপর

শ্রীমদভগবদগীতা ৭.২১ তে বলা হয়েছে-

“যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চিতুমিচ্ছতি ।

তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম ।।”

“পরমাত্মারূপে আমি সকলের হৃদইয়ে বিরাজ করি। যখনই কেউ দেবতাদের পূজা করেতে ইচ্ছা করে, তখনই আমি সেই সেই ভক্তের তাতেই অচলা শ্রদ্ধা বিধান করি”

অর্থ্যাৎ-

ভগবান প্রত্যেককেই স্বাধীনতা দিয়েছেন, তাই কেউ যদি জড় সুখভোগ করার জন্য কোন দেবতার পূজা করতে চাই, তখন সকলের অন্তরে পরমাত্মারূপে বিরাজমান পরমেশ্বর ভগবান তাদের সেই সমস্ত দেবতাদের পূজা করার সব রকম সুযোগ-সুবিধা দান করেন। সমস্ত জীবের পরম পিতা ভগবান কখনও তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন না, পক্ষান্তরে তিনি তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার সব রকম সুযোগ-সুবিধা দান করেন।

এরপর

শ্রীমদভগবদগীতা ৭.২২ তে বলা হয়েছে-

স তয়া স্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে ।

লভতে চ ততঃ কামান্ময়ৈব বিহিতান হি তান ।।

সেই ব্যাক্তি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে সেই দেবতার আরাধনা করে এবং সেই দেবতার কাছে থেকে আমারই(ভগবান) দ্বারা বিহিত কাম্য বস্তু অবশ্যই লাভ করে।


তাই হিন্দুদের মূর্তিপূজা করার স্বাধীনতার আছে। তাই কেউ যদি মূর্তি পূজা করে সেটাও হিন্দু ধর্ম সম্বত আর কেউ যদি মূর্তি না করে সেটাও হিন্দু ধর্ম সম্বত, কারন হিন্দু ধর্মে ভগবান সাকার ও নিরাকার উভয় মাধ্যমে পূজিত হয়। হ্যাঁ তবে দেবদেবতার আরাধনা না করে এক ভগবানের আরাধনা করাই উৎকৃ্স্ট। কিন্তু এই উৎকৃ্স্ট পথে, এক লাফে যাওয়া কোনো দিনও সম্ভব নয়। এর জন্য প্রথমে সাকারবাদি হতে হবে তারপর নিরাকারবাদি।


আশা করি সকলে মূর্তি পূজা কি এবং কেন করা হয় তা বুঝতে পেরেছেন।যারা সনাতনিদের প্রতিমা পূজা কে পৌত্তলিক বলে, তাঁদের দার্শনিক দারিদ্রতাই এখানে প্রবলভাবে ফুটে ওঠে।কারণ সনাতন দর্শনেই সাকার ও নিরাকার উভয় ধরনের উপাসনার মাধ্যমে ঈশ্বর পূজিত হন, আর এভাবে জগতের সকল মত আর পথকে সনাতন দর্শন তার অংশ করে নিয়েছে বলে সব পথেরই শেষ এক এই ঠিকানা।


সর্বোপরি:


হিন্দুধর্মে ঈশ্বরের নিরাকার ও সাকার উভয় রূপের উপাসনার বিধান আছে। নিরাকার ঈশ্বরের কোন প্রতিমা নাই। যারা ঈশ্বরের অব্যক্ত বা নিরাকার উপাসনা করেন তাঁদের বলা হয় নিরাকারবাদী। আর যারা ঈশ্বরের সাকার রূপের উপাসনা করেন তাঁরা সাকারবাদী। গীতায় বলা আছে, যারা নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন তারাও ঈশ্বর প্রাপ্ত হন। তবে নির্গুণ উপাসকদের কষ্ট বেশি। কারণ নিরাকার ব্রহ্মে মনস্থির করা স্বভাবগতভাবে অস্থিরমতি বলে মানুষের পক্ষে খুবই ক্লেশকর। কিন্তু সাকারবাদীদের সাকার ভগবানের উপর মনস্থির করা তুলনামূলক সহজ। কিন্তু উত্তম হল নিরাকার ঈশ্বরের উপসনা।


তথ্যসূত্র :

1. Harun Al Nasif=> পোস্ট এর লিঙ্ক.


2. আমরা কেনো মূর্তি পুজা করি ? হিন্দুরা কি পৌত্তলিক ? মূর্তির প্রান নাই, তবু কেন তাঁর উপাসনা করা হয় ? webpage link


3. নবগ্রহ - উইকিপিডিয়া 


4. মহাকালের গল্পে গল্পে মানব বিবর্তনের ইতিহাস, পর্ব ১

Post a Comment

উপরের তথ্যটি সম্পর্কিত আপনার কোন জিজ্ঞাসা আছে? বা এর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে এমন কোন বিষয় জানার আছে? থাকলে অবশ্যই সুরুচিপূর্ণ কমেন্ট করে জানান, আমরা নিশ্চয়ই আপনাকে বিষয়টি জানানোর চেষ্টা করব এবং এতে উভয়ের জ্ঞানের প্রসার ঘটবে।

Previous Post Next Post