যেকোন ধরণের ধর্মীয় প্রশ্নের উত্তর জানতে বামে মেজেজ্ঞার আইকনে ক্লিক করে আমাদের প্রশ্নটি লাইভ চ্যাটের মাধ্যমে জানান, SanatanLive.blogspot.com

মেধস মুনির আশ্রম

চট্টগ্রামের কাছেই মুগ্ধতায় ভরপুর এক জায়গা- মেধস মুনির আশ্রম।


চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার করলডেঙ্গার সন্ন্যাসী পাহাড়, সেখানে অবস্থিত চণ্ডী তীর্থ মেধস আশ্রম যা মেধস মুনির আশ্রম নামে অধিক পরিচিত। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক তীর্থস্থান।


গুরুত্ব:


মার্কন্ডেয় পুরান:


মার্কন্ডেয় পুরান, শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম্ বা দেবীভাগবত পূরানে উল্লেখ রয়েছে ঋষি মেধসের এই আশ্রমের। মার্কন্ডেয় পুরান অনুযায়ী দেবী দুর্গামর্তলোকে সর্ব প্রথম এই ঋষি মেধসের আশ্রমে অবতীর্ণ হন। ঋষি মেধসের এই আশ্রম বাংলাদেশ বঙ্গএর চট্টগ্রামে অবস্থিত। শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থে কথিত রয়েছে, রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি, মেধস মুনির কাছেই প্রথম দেবীমাহাত্ম্যম্ এর পাঠ নেন এবং এই স্থানে প্রথম দুর্গাপুজো করেন।


রামায়ণে বর্ণিত রামচন্দ্রের দুর্গাপূজারও বহু আগে সত্যযুগে এখানে দেবী দুর্গার পূজা হয়েছিল৷ ধার্মিক রাজা সুরথ শত্রুদের চক্রান্তে রাজ্য হারিয়ে বহু পাহাড় জঙ্গল ঘুরে শেষমেশ এসে উপস্থিত হন মেধস মুনির আশ্রমে। মেধস মুনির পরামর্শে রাজ্য ফিরে পাবার আশায় দেবী দুর্গার পূজা করেন তিনি৷ দেবীর আশির্বাদপুষ্ট হয়ে শেষপর্যন্ত রাজ্য ফিরে পান রাজা। সেই থেকে দুর্গাপূজার সূত্রপাত। সেই ঘটনার সূত্র ধরে দুর্গা পূজার উৎপত্তিস্থল হিসেবে বিখ্যাত মেধস মুনির আশ্রম। 


চিহ্ণিতকরণ :


বরিশালের গৈলা অঞ্চলের পণ্ডিত জগবন্ধু চক্রবর্তীর বাড়িতে ১২৬৬ বঙ্গাব্দে ২৫ অগ্রহায়ণ মাসে চন্দ্রশেখর নামে একপুত্র সন্তানের জন্ম হয় । জন্মের দু’বছর পর জগবন্ধু মারা যান। মায়ের অনুরোধে চন্দ্রশেখর ১৪ বছর বয়সে বিয়ে করেন মাদারীপুরের রাম নারায়ণ পাঠকের কন্যা বিধুমুখীকে। ছয় মাস পর মারা যান স্ত্রী। এর কিছুদিন পর মাও মারা যান। সংসারে আপন বলতে আর কেউ রইল না। একাকীত্ব জীবনে এসে চন্দ্রশেখর নানা বেদ শাস্ত্র পাঠ করে হয়ে ওঠেন পরিচিত পণ্ডিত। তখন নাম হলো শীতলচন্দ্র। তিনি মাদারীপুরে প্রতিষ্ঠা করেন সংস্কৃত কলেজসহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে যোগীপুরুষ স্বামী সত্যানন্দের সাথে সাক্ষাতের পর চন্দ্রশেখরের মনে চন্দ্রনাথ দর্শনের আগ্রহ জন্মে। তিনি চলে আসেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। সেখানে তিনি বৈরাগ্য ধর্ম গ্রহণ করেন। ততদিনে চন্দ্রশেখর হয়ে ওঠেন বেদানন্দ স্বামী। সেখানে যোগবলে বেদানন্দ দর্শন লাভ করেন চন্দ্রনাথের (শিব)। চন্দ্রনাথ সেই দর্শনে বেদানন্দকে পাহাড়ের অগ্নিকোণে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার আদেশ দিয়ে বলেন, ‘দেবীর আবির্ভাবস্থান মেধস আশ্রম পৌরাণিক শত সহস্র বছরের পবিত্র তীর্থভূমি। কালের আবর্তে সেই পীঠস্থান অবলুপ্ত হয়ে পড়েছে। তুমি স্বীয় সাধনবলে দেবীতীর্থ পুনঃআবিষ্কার করে তার উন্নয়নে মনোনিবেশ কর। দেবী দশভুজা দুর্গা তোমার ইচ্ছ পূরণ করবে।’ দৈববলে প্রভু চন্দ্রনাথের আদেশে বেদানন্দ স্বামী পাহাড়-পর্বত পরিভ্রমণ করে পবিত্র এ তীর্থভূমি মেধাশ্রম আবিষ্কার করেন।


ইতিহাসে সর্বশেষ: 


১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আশ্রমটি আবারো ধ্বংস হয়ে যায়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সমগ্র জায়গাটিকে ছাইয়ের স্তূপে পরিণত করে ও ছয় ফুট লম্বা দেবমূর্তি ধ্বংস করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই পবিত্র আশ্রমের যত্ন নেওয়ার মতো কেউ ছিল না। ভক্ত, সাধু ও পণ্ডিতদের সমন্বয়ে আশ্রম কমিটি পুনর্গঠিত হয়। 


ভোগলিক বর্ণনা:


প্রায় পাচঁশো ফুট উঁচু এই পাহাড়ে গেলে দেখা মিলবে মনোরম সব দৃশ্যের। তাই শুধু ধর্মীয় তীর্থস্থান হিসেবেই নয় পর্যটন এলাকা হিসেবেও জায়গাটি যথেষ্ট সমাদৃত। তবে হালের ক্রেজ চন্দ্রনাথ পাহাড়ের মতন এর অত প্রসার নেই একথা বলা বাহুল্য! তবে মন ভালো করে দেবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এই জায়গার!


প্রাকৃতিক সৌন্দর্য :


এখানে নানাবিধ প্রজাতির প্রচুর গাছপালা লাগানো হয়েছে। শিউলি, বাগানবিলাস, মধুমঞ্জুরী, কাঠগোলাপ, হাসনাহেনা, জবা, করবী, কৃষ্ণচূড়া, কনকচূড়াসহ আরো অসংখ্য গাছপালার ঘনসবুজ সমারোহ। মন্দিরে যাবার পথে আর্য ভাবনা কমপ্লেক্সের ধারে দেখা পাবেন সারি সারি গোলাপী রঙের দাঁতরাঙা ফুলের। মন্দির এলাকায় পাহাড়ের কিনারা ঘেঁষে দুর্বাঘাসে লুটিয়ে থাকা শিউলিদল স্নিগ্ধ অনুভব এনে দেয় মনে৷ মন্দিরে ঢোকার আগে আগে পথের ধারে রয়েছে একটি পদ্মপুকুর। এখনো পদ্ম ফুটে আছে। চাইলে খুব কাছ থেকে সে দৃশ্য দেখে আসতে পারবেন৷ 


মঠ ও মন্দির :


মূল মন্দির চণ্ডী মন্দির সহ আরো বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে এখানে।আশ্রমে চণ্ডী মন্দির, শিব মন্দির, সীতা মন্দির, তারা কালী মন্দিরসহ ১০টি মন্দির রয়েছে। রয়েছে সীতার পুকুর।আশ্রমের প্রধান ফটক দিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার গেলে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। প্রায় ১৪০টি সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর প্রথমেই মেধস মুনির মন্দির। এই মন্দিরের পরই দেবী চণ্ডীর মূল মন্দির। এর একপাশে সীতার পুকুর, পেছনে রয়েছে ঝরনা। মূল মন্দিরের ডানপাশে নেমে গেছে সীতার পুকুরের সিঁড়ি৷ সেখান থেকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠলে তারা মন্দির। এখান থেকে পাহাড় আর দূরের সমতল দেখে কাটিয়ে দেয়া যায় অনেকটা সময়! তারা মন্দির থেকে সরু সুদৃশ্য পথ বেয়ে শিবমন্দির। শিবমন্দিরের চারপাশের দৃশ্য সময় নিয়ে দেখা উচিত। শিবমন্দির থেকে কামাখ্যা মন্দিরের পথ। সেখান থেকে মূল মন্দির। মূল মন্দিরের অপরপাশে কালী মন্দির যাবার সিঁড়ি নেমে গেছে। 


নতুন ভাবনা আবিষ্কার:


পদ্মপুকুরের আগে মগদেশ্বরী মাতৃ মন্দিরের অপরপাশে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সরু একটা গিরিপথ আছে৷ রোমাঞ্চপ্রিয় আর নতুন জায়গা আবিষ্কারের নেশা থাকলে তার ভেতর দিয়ে যেতে পারেন৷ পথ বহুদূর! লেবুচাষীরা এই পথ দিয়েই কাঁধভর্তি লেবুর বস্তা নিয়ে আসে দূরের বাগান থেকে। তবে এখানে জোঁকের আক্রমণ খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। 


থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা:


নির্জনে সময় কাটানোর জন্য জায়গাটা উত্তম! এলাকাটি নির্জন হলেও নিরাপদ। চাইলে সেখানে খেতেও পারবেন৷ সত্তর টাকার বিনিময়ে মিলবে একবেলার খাবার৷ মন্দিরের নিচে দুটো দোকান আছে। হালকা পাতলা খাবার ওখানেই পাবেন। মন্দিরের পেছনে সাধু সন্ন্যাসী ও পুণ্যার্থীদের থাকার জন্য রয়েছে দোতলা ভবন। প্রায় ৬৮ একর জায়গাজুড়ে স্থাপিত হয়েছে এই মন্দিরে প্রতিবছর মহালয়ার মাধ্যমে দেবী পক্ষের সূচনা হয়এই মন্দিরে।


মেধস মুনির আশ্রমে কিভাবে যাবেন?


কিভাবে যাওয়া যায়:

চট্টগ্রাম বহদ্দরহাট বাস টার্মিনাল হতে বাসযোগে অথবা সিএনজি ট্যাক্সিযোগে সরাসরি বোয়ালখালী উপজেলা পরিষদ নামতে হবে। এরপর কানুনগোপাড়া কালাইয়ার হাট এর বাম পাশ দিয়ে কিছুদূর অতিক্রমের পর করলডেঙ্গা পাহাড়ের চুড়ায় মেধসমুনি আশ্রম পেয়ে যাবেন।






সচেতনতা:


জায়গাটা এখনো মানুষের কাছে অতটা পরিচিত নয়। তাই এখনো অনেকটাই সতেজ রয়েছে বলা যায়। ঘুরতে গিয়ে এই ব্যাপারে সচেতন থাকুন। অপঁচনশীল দ্রব্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন। যেহেতু ধর্মীয় তীর্থস্থান এর পবিত্রতা রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন। যেখানেই যান নিচের সুরুচির পরিচয় দিন।


ছবিতে মেধস মুনির আশ্রমের একাংশ:


















সংগৃহিত ও পরিমার্জিত।


তথ্যসূত্র :


1. তথ্য পোর্টাল


2. উইকিপিডিয়া 


Post a Comment

উপরের তথ্যটি সম্পর্কিত আপনার কোন জিজ্ঞাসা আছে? বা এর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে এমন কোন বিষয় জানার আছে? থাকলে অবশ্যই সুরুচিপূর্ণ কমেন্ট করে জানান, আমরা নিশ্চয়ই আপনাকে বিষয়টি জানানোর চেষ্টা করব এবং এতে উভয়ের জ্ঞানের প্রসার ঘটবে।

Previous Post Next Post