ভগবান শ্রীমদ্ভগবদগীতার দশম অধ্যায়ে বিভূতি প্রসঙ্গে বলেছেন, "যজ্ঞানাং জপযজ্ঞোঽস্মি"। অর্থাৎ সকল যজ্ঞের মধ্যে তিনি জপরূপ যজ্ঞ। শাস্ত্রে জপ অত্যন্ত পবিত্র একটি তপস্যা। শ্রীচৈতন্যদেব, শ্রীনিত্যানন্দ, নামদেব সহ অসংখ্য সাধক মহাপুরুষেরা ভগবানের দর্শন পেয়েছেন শুধুই অহর্নিশি ভগবানের শ্রীনাম জপ এবং কীর্তনের মাধ্যমে। শাস্ত্রে হরিনাম যুক্ত বিবিধ শ্লোক দৃষ্ট হয়। তবে এরমধ্যে বর্তমানকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় হলো ষোল নাম বত্রিশ অক্ষরের সংস্কৃত ভাষায় লিখিত "হরে কৃষ্ণ" শ্লোকটি। তবে বঙ্গদেশে বর্তমানে শ্লোকটি কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে পাওয়া যায়। বঙ্গদেশে প্রথম লাইন "হরে রাম" স্থলে দ্বিতীয় লাইন "হরে কৃষ্ণ" প্রথম লাইন হিসেবে পরিদৃষ্ট হয়।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।।
শাস্ত্রের বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে, ভগবানের দিব্য নামের প্রভাবে অনায়াসেই মুক্ত হয়ে যাওয়া যায়। তবে সেই নাম এবং কীর্তন একাগ্রতায় সাথে করতে হবে এবং নিষ্কামভাবে করতে হবে। তবেই নামের প্রভাবে জীব ভবতরী পাড়ি দিতে পারবে। কিন্তু ভগবানের দিব্য নামকে যদি কেউ অর্থের বিনিময়ে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে, তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। শাস্ত্রীয় নিষ্কাম ঈশ্বর সাধনার মাধ্যমকে যিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তার মধ্য থেকে রাজসিক এবং সাত্ত্বিক গুণ তিরোহিত হতে থাকে। পক্ষান্তরে তামসিকতার অন্ধকার ধীরেধীরে তাকে গ্রাস করে নেয়। মানব জীবনে অর্থের অত্যন্ত প্রয়োজন রয়েছে ।কিন্তু তা সকল ক্ষেত্রে নয়। বর্তমানকালে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে বিশেষ করে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে একটি পেশা দেখা; পেশাটি হলো হরিনামবিক্রয় পেশা। এ পেশা অবলম্বন করে বাংলায় অসংখ্য পেশাদার কীর্তনীয়া রয়েছেন, অর্থের বিনিময়ে হরিনাম করাই যাদের জীবিকা। এই হরিনামবিক্রয় নামক পেশাজীবী ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধর্মীয় মহোৎসব উপলক্ষে টাকার বিনিময়ে হরিনাম কীর্তন করে থাকে। অর্থের বিনিময়ে হরিনাম সংকীর্তন করেই সেই ব্যক্তিরা তাদের স্ত্রীপুত্রসন্তান পরিপোষণ করেন। বিষয়টি বঙ্গদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও, শাস্ত্রের সম্পূর্ণভাবে সমর্থন নেই। বিষয়টি সম্পর্কে শাস্ত্রে বহুপূর্বেই সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভগবান নারায়ণ বলেন:
হরের্নামবিক্রয়িনো ভবিষ্যন্তি কলৌ যুগে।
স্বয়মুৎসৃজ্য দানঞ্চ কীর্তির্বর্ধনহেতবে।।
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ:প্রকৃতিখণ্ড,৭.৪৩)
"ভবিষ্যতে কলিযুগে হরিনাম বিক্রি করে অর্থাৎ অর্থ নিয়ে হরিনাম সঙ্কীৰ্ত্তন করে হরিনামের বিক্রেতাগণ জীবিকা নির্বাহ করবে এবং সকলেই কীর্তি-বর্ধনের নিমিত্তেই ধনাদি দান করবে।"
পবিত্র হরিনাম কীর্তন বা জপ সর্বদা নিজে করে অন্যদের করতে উৎসাহিত করা উচিত। কিন্তু সেই পবিত্র হরিনামকে কলির তমগুণের প্রভাবে কিছু ব্যক্তি যখন জীবিকা নির্বাহের উপায় হিসেবে গ্রহণ করে, তখন বিষয়টি অত্যন্ত আপত্তিজনক হয়ে উঠে। মানুষ এমন কর্ম তখনই করবে, যখন কলিযুগের আগমন ঘটবে এবং ধর্মের চারপাদের মধ্যে একপাদ মাত্র অবশিষ্ট থাকবে। এভাবে দিনেদিনে অধর্মের বাড়বাড়ন্তে কলির শেষে ধর্ম সমস্তই প্রায় নিঃশেষ হতে থাকবে। সনাতন ধর্মের কোন শেষ নেই। এর আছে প্রসারিত অবস্থা এবং সংকুচিত অবস্থা। জগতে যখন সাত্ত্বিক গুণের প্রবৃদ্ধি ঘটে তখন চতুষ্পাদ ধর্ম প্রসারিত অবস্থায় থাকে এবং বিপরীতে যখন তামসিক গুণের প্রবৃদ্ধি ঘটে তখন চতুষ্পাদ ধর্ম সংকুচিত অবস্থায় থাকে।কলিযুগে সকল অধর্মের শেষে পরবর্তীতে আবার নতুন করে সৃষ্টি শুরু হবে, সত্যযুগের পুনরায় আগমন ঘটবে। এভাবেই সৃষ্টি এবং বিসৃষ্টি বৃত্তাকারে আবর্তিত হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে।
ধর্মস্ত্রিপাচ্চ ত্রেতায়াং দ্বিপাচ্চ দ্বাপরে স্মৃতঃ।
কলৌ প্রবৃত্তে চৈকপাচ্চ সর্বলুপ্তস্ততঃপরং।।
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ:প্রকৃতিখণ্ড,৭.৬৮)
"সত্যযুগে ধর্ম চতুষ্পাদ, ত্রেতাযুগে ত্রিপাদ, দ্বাপরে দ্বিপাদ এবং কলির প্রারম্ভে একপাদ; এরপরে একেবারে সমস্তই বিলুপ্ত হবে।"
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে অর্থের বিনিময়ে হরিনাম করে হরিনামের বিক্রেতা না হতে যেমন প্রচ্ছন্ন নিষেধ করা হয়েছে। হরিনাম ভগবানের দিব্যনাম, যা জগতকে উদ্ধার করে। তাই পবিত্র এবং দিব্য এ হরিনাম নিয়ে ব্যবসা করা সম্পূর্ণভাবে অনুচিত।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়