মহাভারতে বেদবিক্রয়কারীকেও নিন্দা করা হয়েছে। সেই সময়ে বর্তমানের মত ছাপা গ্রন্থ ছিলো না। গ্রন্থগুলো ছিলো হাতে লেখা পুঁথি। বেদের সেই সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ আদি বিভিন্ন পুঁথি দানকে অত্যন্ত পুণ্যের বলা হয়েছে। যুগপৎভাবে যারা বেদবিক্রয়কারী তাদের এমন ব্যক্তিদের পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে- যারা ঠিকমত রোগির চিকিৎসা করেন না সেই চিকিৎসক; যারা রোগীর যথাযথভাবে অপারেশন করেন না, সেই শল্যকর্তা; যারা ব্রহ্মচর্য ব্রত গ্রহণ করেও সেই পবিত্র ব্রত থেকে বিচ্যুত; যারা অন্যের ধন চুরি করে বেড়ায়; যারা অত্যন্ত নিষ্ঠুর ক্রুর স্বভাবের; যারা মদ্যপান করে; যে সৈনিক যথাযথভাবে তার দেশরক্ষার দায়িত্ব পালন করেন না। এ সকল ব্যক্তি অতিথি হয়ে কারো গৃহে আগমন করলে, গৃহস্বামীর সামান্য পা ধোওয়ার জলও প্রদান করা উচিত নয় তাদের। কারণ তারা আপ্যায়নের যোগ্য নয়।
চিকিৎসকঃ শল্যকর্তাহ্বকীর্ণী
স্তেনঃ ক্রূরো মদ্যপো ভ্রণহা চ।
সেনাজীবী শ্রুতিবিক্রায়কশ্চ
ভৃশং প্রিয়োঽপ্যতিথির্নোদকার্হঃ।।
(মহাভারত: উদ্যোগ পর্ব, ৩৮.৪)
"চিকিৎসক, শল্যকর্তা, ব্রহ্মচর্যভ্রষ্ট, চোর, ক্রুর, মদ্যপায়ী, ভ্রণহত্যাকারী, সৈনিক এবং বেদবিক্রয়কারী এরা অত্যন্ত প্রিয় অতিথি হলেও পাদ প্রক্ষালনের যোগ্য নয়।"
(৩৮.৩) শ্লোকে বলা হয়েছে, গৃহে আগত সকল অতিথিকে জল এবং মধুপর্ক দিয়ে সাধ্যমত আতিথিয়েতা এবং সেবা করতে। কিন্তু গৃহে আগত সকল অতিথিকে সেবা করার নির্দেশনা দেয়া হলেও, যারা বেদবিক্রয়কারী তাদের সহ কয়েকজন ব্যক্তিদের সেবা, শুশ্রূষা এবং আপ্যায়ন না করতে বলা হয়েছে ।বেদবিক্রয়কারীরা যদি ব্যক্তিগতভাবে গৃহস্বামীর অত্যন্ত প্রিয় হয়, তবেও তাদের গৃহে আশ্রয় দেয়া অনুচিত। প্রাচীন ভারতবর্ষে নিয়ম ছিলো, গৃহে অতিথি আগমন করলে প্রথমে তাকে পা ধোয়ার জল প্রদান করা হত। কিন্তু মহাভারত সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বেদবিক্রয়কারী অতিথিকে গৃহে জল মধুপর্ক সহ সুস্বাদু খাবার দিয়ে সমাদর করা দূরে থাক; তাদের সামান্য পা ধোওয়ার জল পর্যন্ত প্রদান করা উচিত নয়।
মহাভারতের উদ্যোগপর্বে বেদবিক্রয়কারীকে অতিথি হিসেবে গৃহে সমাদর না করার নির্দেশনা দেখে; অনেকেই বিষয়টির গভীরে চিন্তা না করে প্রাথমিকভাবে বিভ্রান্ত হতে পারে। তাদের মনে প্রশ্ন যে, বেদবিক্রয় যদি শাস্ত্রে নিষিদ্ধ হয়, তবে বেদের প্রচার প্রসার কি করে হবে? প্রশ্নটি বর্তমানকালের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং যৌক্তিক।শাস্ত্রে সকলের মাঝে বেদের ব্যাপক প্রচার করতে কোথাও সামান্যতম নিষেধ করা হয়নি। শুধু বেদ নিয়ে ব্যবসা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ বেদ পরমেশ্বরের দৈবীবাণী। জগতে এমন গ্রন্থ একটি। তাই জগতের অন্য সকল কোটিকোটি গ্রন্থ থেকে বেদের প্রসার প্রসার পদ্ধতি এবং শুদ্ধতা রক্ষার পদ্ধতি ভিন্ন হবেই।বেদের জ্ঞান কোন ব্যক্তিগোষ্ঠী বিশেষের মধ্যে আবদ্ধ নয়। বেদের জ্ঞান সর্বজনীন জগতের সকল মানবমাত্রের। তাই প্রচারের মাধ্যমে বেদের জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন।শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতায় বলা হয়েছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র, মিত্র ও শত্রু, আপন - পর; জগতের কোন মানবই যেন বেদজ্ঞান থেকে বঞ্চিত না হয়।
যথেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ।
ব্রহ্মরাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্যায় চ স্বায় চারণায় চ।
প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ
ভূয়াসময়ং মে কামঃ সমৃধ্যতামূপ মাদো নমতু।।
(শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা:২৬.২)
"আমি যেমন এই কল্যাণকারিণী বেদবাণী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,শূদ্র, বৈশ্য নির্বিশেষে সবাইকে বেদের জ্ঞান দান করেছি, তেমনি তোমরাও তোমাদের প্রিয়জন থেকে শত্রু সবাইকেই বেদের জ্ঞান প্রদান করে দেবতা সহ সকলের প্রিয় হও এবং পরিশেষে আমাকে প্রাপ্ত হও।"
আমাদের উচিত আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করা যেন তারা বেদের প্রচার প্রচারে সাহায্য সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। কারণ বেদ ভগবানের মুখের শাশ্বত বাণী। স্বার্থহীনভাবে বেদের প্রচার প্রসারেই জীবের পরম কল্যাণ।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়